কলকাতা সংবাদদাতা:করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেলে ২০২১ সালের মে মাসে রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হওয়ার কথা। রাজ্য বিজেপি স্বপ্ন দেখছে সেই নির্বাচন জিতে বাংলার ক্ষমতায় আসবে। তার মানে, এখনও আসেনি। অথচ, তার আগেই রাজ্য বিজেপিতে যে ভাবে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে, তাতে বিজেপি নেতারা কী করে রাজ্যের ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখছেন, সেই প্রশ্নই এখন ঘোরাফেরা করছে রাজনৈতিক মহলে।
দিল্লিতে সাতদিন ধরে রাজ্য বিজেপির সাংগঠনিক বৈঠক হয়েছে সোমবার। সেই বৈঠকে যে ভাগে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের চেহারাটা প্রকট হয়ে উঠেছে, তা নিয়ে এখন চিন্তায় পড়ে গিয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় নেতারাই। সূত্রের খবর, শেষদিনের বৈঠকে তো খোলাখুলি ক্ষোভে ফেটে পড়েন সাংসদ অর্জুন সিং। তিনি অভিযোগ করেন, ‘রাজ্য বিজেপির সমস্ত ক্ষমতা ২–৩ জন নেতার হাতেই রয়েছে। তাঁরাই রাজ্যে দলটাকে পরিচালনা করছেন। বাকিদের কোনও গুরুত্বই নেই।’ শুধু তাই নয়, রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ, নিজের চেষ্টায় তিনি যখন বিজেপির পক্ষে ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলকে ধরে রাখছেন, তখন রাজ্য নেতৃত্বের সহযোগিতা সে ভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। রাজনৈতিক মহলের মতে, তাঁর নিশানায় যে বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ এবং সাংগঠনিক সম্পাদক সুব্রত চট্টোপাধ্যায়, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
যদিও এইসব খবর সবই সূত্র মারফত পাওয়া। প্রকাশ্যে অর্জুন সিং এ সব কথা স্বীকার করেননি। বরং বলেছেন, ‘দলের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কারও কোনও অভিযোগ ছিল না। বৈঠক হয়েছে শান্তিপূর্ণই।’ এমনকী, সুব্রত চট্টোপাধ্যায়ও বলেছেন, ‘বিজেপির ক্ষতি করার জন্যই কিছু রাজনৈতিক শক্তি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে এ সব খবর রটাচ্ছে।’ তবে এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের চর্চা নিয়ে দিলীপ ঘোষের কোনও মতামত পাওয়া যায়নি। কিন্তু ওয়াকিবহাল মহলের মতে, বেশ কিছুদিন ধরেই দিলীপ ঘোষের বিরুদ্ধে অনেক নেতাই গোপনে ক্ষোভের কথা জানিয়ে আসছিলেন। বিশেষ করে তৃণমূল থেকে আসা নেতা ও কর্মীরা বেশি অভিযোগ করছিলেন। সেই তালিকায় রয়েছেন শোভন চট্টোপাধ্যায়, বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে মুকুল রায়, অর্জুন সিং পর্যন্ত সকলেই।
আর এই কারণেই তৃণমূল থেকে অনেক আঞ্চলিক নেতা ও কর্মী বিজেপিতে এসেও পরে বিরক্ত হয়ে ফের তৃণমূলে ফিরে গিয়েছেন। দিলীপ ঘোষেরও এ কথাও অজানা ছিল না। তবে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তাঁর ওপর আস্থায় রাখায় তিনি নিজের অবস্থান থেকে সরে যাননি। এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তো সরাসরি দলের অভ্যন্তরে এই ক্ষোভের দিলীপ ঘোষকেও জানিয়েছিলেন। কিন্তু দিলীপ ঘোষ তাঁর কথা উড়িয়ে দেন। দিল্লি সূত্রে জানা গিয়েছে, এক সাংসদ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বেকে জানিয়েছেন, ‘সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডা যদি বাংলার ১৮ জন সাংসদের সঙ্গে কথা বলেন, ১৫ জনই রাজ্য নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কথা বলবেন।’ তিনি এই প্রশ্নও তুলেছেন, ‘দিলীপদারা কেন যে সকলকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে চাইছেন না, তা বোঝা যাচ্ছে না।’
আর তৃণমূল থেকে আসা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা তো বলেই দিয়েছেন, ‘আমরা যাঁরা দলে নতুন এসেছি, তাঁদের একঘরে করে রাখা হয়েছে।’ সাতদিন ধরে চলা বিজেপির বৈঠকে সেইসব ক্ষোভ অনেকেই উগরে দিয়েছেন বলে খবর। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে, দিলীপ ঘোষ নাকি বিরক্ত হয়ে রাজ্য সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দিতেও চেয়েছিলেন! যদিও রাজ্য বিজেপির তরফে এ কথা স্বীকার করা হয়নি। ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রটনা এবং অপপ্রচার’ বলে সব অভিযোগই উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আরও একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছে দিল্লিতে। সপ্তাহব্যাপী বৈঠক দিল্লিতে শেষ হয়ে গিয়েছে। অনেক নেতাই বাংলায় ফিরে এসেছেন। কিন্তু অনেকে থেকেও গিয়েছেন।
দিল্লির বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে, বৈঠক শেষ হয়ে গেলেও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়র দেওয়ার এক মধ্যাহ্নভোজে মিলিত হয়েছিলেন অনেক নেতাই। তাতে নাকি অন্তত ৭ জন সাংসদ উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে যাঁদের নাম শোনা যাচ্ছে, সেই তালিকায় স্বপন দাশগুপ্ত, অর্জুন সিং, সৌমিত্র খাঁ, নিশীথ প্রামাণিক, জগন্নাথ সরকার প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। সবচেয়ে রহস্যময় হল এ বিষয়ে দিলীপ ঘোষের প্রতিক্রিয়া। তিনি জানিয়েছেন, এমন ভোজের ব্যাপারে তাঁর কিছু জানা নেই। তবে বিষয়টির মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকতা তিনি দেখতে পাননি।
কিন্তু, সত্যিই কি তাই? বিজেপির অভ্যন্তরেও বিষয়টি নিয়ে চর্চা জোরদার হয়েছে। আরও রহস্যজনক হল, সাতদিনের বৈঠকে একদিনও যাননি স্বয়ং বাবুল সুপ্রিয়। যাননি রাজ্যসভায় বিজেপির সাংসদ স্বপন দাশগুপ্তও। এখানেই শেষ নয়, বিজেপির রাজ্য নেতারা দাবি করেছিলেন, দিল্লির সাতদিনের বৈঠকে অমিত শাহ, জে পি নাড্ডা–সহ আরও অনেক কেন্দ্রীয় নেতা উপস্থিত থাকবেন। কিন্তু অরবিন্দ মেনন, কৈলাশ বিজয়বর্গীয়, শিব প্রকাশ ছাড়া কোনও কেন্দ্রীয় নেতাই বৈঠকে আসেননি। আর এই তিনজন নেতাকে দিল্লির নেতা বলা গেলেও তাঁরা বাংলার দায়িত্বপ্রাপ্ত। তাই তাঁদের কেন্দ্রীয় নেতা বলে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টাই করা হবে বলে অনেকেই মনে করছেন।
কিন্তু কেন্দ্রের শীর্ষস্তরের আর কোনও নেতাকেই বৈঠকে দেখা যায়নি। অথচ তাঁদের সঙ্গে রাজ্য বিজেপির তরফে অনেক বিক্ষুব্ধ সাংসদ ও নেতা যোগাযোগ করেছেন বলে জানা গিয়েছে। তাই দলের অভ্যন্তরে দ্বন্দ্বের বিষয়টা যে আরও গভীরে যেতে পারে, এমনই মনে করছেন রাজ্যের রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা।